গত ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০২৪-এর আলোচনায় মাননীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জনাব ডা. সামন্ত লাল সেন পরোক্ষ ধূমপানের ভয়াবহতা উল্লেখ করে বলেন, “পরোক্ষ ধূমপানও অধূমপায়ীদের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপান ও তামাক সেবনের কারণে হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, ক্রনিক লাং ডিজিজসহ নানা অসংক্রামক রোগ দেখা দেয়। তামাকের কারণে পৃথিবীতে প্রতিবছর ৮৭ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়।“ মাননীয় মন্ত্রীর এই বক্তব্য গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে, কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, প্রতি বছর তামাক গ্রহণের কারণে যে ৮০ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে ১২ লাখের মতো মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী পরোক্ষ ধূমপান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি তথ্য বলছে, পরোক্ষ ধূমপানের ফলে প্রায় ৭,০০০ প্রকারের রাসায়নিক পদার্থ মানবদেহে প্রবেশ করে, যা শিশু, গর্ভবতী নারী এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক এবং তা সকলের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায়। এর ফলে শিশুদের আকস্মিক মৃত্যু থেকে শুরু করে, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, কানের সংক্রমণ এবং গুরুতর হাঁপানি হতে পারে। অন্যদিকে, পরোক্ষ ধূমপানের ফলে গর্ভবতী নারীদের ভ্রূণের ক্ষতি ছাড়াও, অকাল প্রসব এবং অপরিণত শিশু জন্মদানের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তাছাড়া, প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে স্ট্রোক, ফুসফুস ও স্তন ক্যানসার, হৃদ্রোগ, পালমোনারি রোগ এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগ সৃষ্টি হতে পারে।
প্রচলিত সিগারেট ছাড়াও সম্প্রতিকালে বাজারে চালু হওয়া হিটেড টোব্যাকো, ই-সিগারেটের ধোঁওয়াতেও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক রয়েছে যা আশেপাশে উপস্থিত মানুষের জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে।
পরোক্ষ ধূমপান এবং বাংলাদেশ
বিভিন্ন গবেষণায় বাংলাদেশে পরোক্ষ ধূমপানের একটি ভয়ংকর চিত্র পাওয়া যায়, এর প্রভাবে প্রতি বছর ২৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় এবং বছরে প্রায় ৬১ হাজারের বেশি শিশু পরোক্ষ ধূমপান জনিত রোগে আক্রান্ত হয়; প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪২.৭ ভাগ মানুষের মধ্যে পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব স্পষ্ট।
দেশে প্রত্যক্ষ ধূমপান রোধে একাধিক কাজ চলমান থাকলেও – পরোক্ষ ধূমপান রোধ করা এবং ধূমপায়ীদের নিরুৎসাহিত করার ব্যাপারে সরকার এবং অন্য অংশীজনদের কাজ করার আরও বিস্তর জায়গা আছে।
শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান এবং তামাক সেবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় চার কোটি কিশোর-কিশোরী (যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৫-এর কোঠায়) প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে তামাক গ্রহণ করে থাকে। সম্প্রতিকালে চালু হওয়া হিটেড টোব্যাকো, ই-সিগারেট সহ বিভিন্ন তামাকজাত পণ্যের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন এবং প্রদর্শনীতে আকৃষ্ট হয়ে শিশু-কিশোররা তামাক ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পরছে যার ফলাফল হচ্ছে ভয়াবহ। ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের উপর পরিচালিত গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৬.৯ ভাগ শিক্ষার্থী তামাক জাতীয় পণ্য ব্যবহার করে। ২.১ ভাগ শিক্ষার্থী নিয়মিত ধূমপান করে থাকে এবং ৪.৫ ভাগ শিক্ষার্থী ধোঁয়া-বিহীন তামাক ব্যবহার করে থাকে।
অন্যদিকে, পরোক্ষ ধূমপানের চিত্র আরও উদ্বেগজনক, গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভের রিপোর্ট বলছে – দেশের ৩১.১ ভাগ শিক্ষার্থী নিজ গৃহে এবং ৫৯ ভাগ শিক্ষার্থী জনসমাগমস্থলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আর্ক ফাউন্ডেশন তামাক নিয়ন্ত্রণমূলক গবেষণার অংশ হিসাবে, পরোক্ষ ধূমপান সম্পর্কে শিশুদের শিক্ষা গ্রহণ – ক্লাস-টু (Children Learning About Second-hand Smoke (CLASS-II) প্রকল্পের অংশ হিসেবে ঢাকার ১২টি স্কুলের ১১-১৩ বছর বয়সী ৪৭৯ জন শিক্ষার্থীদের মুখের লালা সহ বিভিন্ন ধরনের নমুনা সংগ্রহ করে, এই পরীক্ষার নমুনা পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের গবেষণাগারে পাঠানো হলে শিউরে উঠার মতো ফলাফল আসতে থাকে। ফলাফলে, ৪৭৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪৫৩ জনের, অর্থাৎ ৯৫ ভাগ শিশুর লালাতে নিকোটিনের উপস্থিতি দেখা যায়। গবেষণা দলের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং আর্ক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক, ড. রুমানা হক এ ব্যাপারে বলেন, “বাসায় বাবা, বড় ভাই কিংবা অন্যকেউ ধূমপান করে, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু। রাস্তায়, বাসে, দোকানে, হোটেলে অনেকে সিগারেট খান, সেই ধোঁয়া যায় শিশুর শরীর।“
ক্লাস-টু প্রকল্পের ধারাবাহিকতায়, আর্ক ফাউন্ডেশন বর্তমানে ক্লাস-থ্রি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো – নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশসমূহে শিশুদেরকে পরোক্ষ ধূমপানের কবল থেকে বাঁচানো এবং এর মাধ্যমে তাদের শ্বাসতন্ত্র এবং ধূমপানের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য স্বাস্থ্যসমস্যা সমূহ প্রতিরোধ করা। বর্তমানে চলমান এই প্রকল্পের অধীনে ঢাকার ৩৪টি স্কুলের ১,৩৮৩ জন শিশুর উপর তারা তাদের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ক্লাস-থ্রি গবেষণা প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য গুলোর মধ্যে রয়েছে – শিশুদের উপর পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব কমানো, তাদের শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার হার এবং এর প্রকোপ কমিয়ে আনা, তাদের জীবনমানের উন্নয়ন, শিশুদের ধূমপায়ী হয়ে উঠার সম্ভাবনাকে কমিয়ে আনা, ধূমপান জনিত অসুস্থতার কারণে বিদ্যালয়ে শিশুদের অনুপস্থিতির হার কমিয়ে আনা, এবং তাদের পড়ালেখার ফলাফলের উন্নতি ঘটানো।
আর্ক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তার সূচনালগ্ন থেকেই তামাকবিরোধী জোটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে জনগণের মধ্যে গবেষণালব্ধ তথ্য উপাত্ত সরবরাহের মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করছে। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপর পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব নিয়ে গবেষণার অংশ হিসেবে ঢাকার শহরতলীতে বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর এর প্রভাব নিয়ে এমক্লাস-টু (Muslim Communities Learning About Second-hand Smoke in Bangladesh (MCLASS II)) প্রজেক্ট পরিচালনা করে। ১,৭৪৬ টি বাসাবাড়ির উপর পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা যায় যে, ৯৬৭টি (৫৫ শতাংশ) ঘরের ভেতরে ধূমপান করার অনুমতি রয়েছে এবং বাকিগুলোকে (৭৭৯টি অথবা ৪৫ শতাংশ) ধূমপান মুক্ত বাড়ি হিসেবে ধরা করা যায়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে দেশ থেকে তামাক নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে সরকার, ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫’ এর সংশোধন, এবং ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০১৫’ প্রণয়ন সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর পাশাপাশি, আঠারো বছরের কম বয়সীদের নিকট তামাকজাত পণ্যের প্রদর্শন এবং বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কিন্তু বিদ্যমান আইনের ফাঁকফোকর বের করে তামাক ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় জনগণের মধ্যে তামাকের ব্যবহার ছড়িয়ে দিচ্ছে, যার ফলে হুমকির মুখে পড়ছে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। এই অবস্থার মধ্যে আশার আলো হচ্ছে সরকার এই হুমকি মোকাবেলায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের একটি খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে।
মাননীয় মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন-এর সম্প্রতি দেওয়া বক্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য, বিগত ৩১ই মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের আলোচনায় মাননীয় মন্ত্রী বলেন, “খসড়া প্রস্তাবে শিশু, নারীসহ অধূমপায়ীদের পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি হতে রক্ষায় পাবলিক প্লেস ও পরিবহণ হতে ধূমপান এলাকা বাতিলের মাধ্যমে শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রস্তাব; কিশোর-তরুণদের নেশার দিকে ধাবিত করতে তামাক কোম্পানিগুলো অযাচিতভাবে ওটিটি, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও নাটক–সিনেমায় ধূমপানের দৃশ্য প্রচার বন্ধের প্রস্তাব যুক্ত হয়েছে; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, খেলাধুলার স্থান ইত্যাদি সীমানার ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক বিক্রয় বন্ধ করা এবং নিবন্ধন ছাড়া তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে; তামাকের আগ্রাসন থেকে শিশু–কিশোরদের সুরক্ষায় তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পরিবারভিত্তিক সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলনের গড়ে তুলতে হবে।“
আমাদের আশা, বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ও বাস্তবায়নের ফলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হবে, এবং তা হবে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ রাফি, সাখাওয়াত হোসেন রানা (আর্ক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ)